May 5, 2024, 3:30 pm

মুদ্রায় বঙ্গবন্ধুর ছবির গল্প

যমুনা নিউজ বিডিঃ বাহাত্তরের ১৪ জুলাই, সন্ধ্যা। মহাখালীর ‘প্রতিচ্ছবি’ স্টুডিওতে বসে কাজ করছিলেন লুৎফর রহমান। এ সময় স্টুডিওর সামনে এসে থামে পুলিশের একটি জিপ। পুলিশ তাকে জিপে তুলে নেয়। জিপটি রমনা পার্কের উল্টো দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সুগন্ধায় গিয়ে থামে। লুৎফর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে দেশি-বিদেশি কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও তিন-চারজন ক্যামেরাম্যান। মাসখানেক আগে জমা দেওয়া ছবি দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোর কাছে এই ছবির নেগেটিভ আছে? এর প্রিন্টেট কপি আর কাউকে দিয়েছিস?’ লুৎফর রহমান বললেন, ‘আওয়ামী লীগের তিনজন কর্মীকে দিয়েছি। তারা আমার বাসার পাশেই থাকে। আর নেগেটিভটি আমার সংগ্রহেই আছে।’ রাত তখন সাড়ে ৯টা। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই ওদের সঙ্গে ওই জিপে করে যা। ছবি তিনটা আর নেগেটিভটি ওদের হাতে পাঠিয়ে দিস। তোর আর আসা লাগবে না।’

পরদিন একজন বিদেশি ভদ্রলোক তাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ডাকলেন। শুরুতেই জানতে চাইলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই ছবি বাবদ কত টাকা চান?’ লুৎফর রহমান বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছবি বিক্রি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আপনি যদি কিছু দিতে চান তাহলে একটা ক্যামেরা উপহার দিতে পারেন।’ বিদেশি ভদ্রলোক প্রথমে তার কথাগুলো কাগজে লিখলেন। এরপর কোম্পানির প্যাডে টাইপ করলেন। সই করার পর একটি কপি লুৎফর রহমানকে দিলেন আরেকটি তার নিজের কাছে রাখলেন। লুৎফর রহমানের সঙ্গে ছবির কপিরাইট নিয়ে এভাবেই যুক্তরাজ্যের ব্রাডবুরি, উইলকিংসন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপকের অফিশিয়াল চুক্তি হলো। পরের মাসে ব্রাডবুরির সেই ব্যবস্থাপক আবারও ঢাকায় এলেন। ২৩ আগস্ট লুৎফর রহমানকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ডাকলেন। সোফায় বসিয়ে চা-বিস্কুট খাওয়ালেন। চা-পর্ব শেষে লুৎফর রহমানের হাতে তুলে দিলেন একটি ইয়াসিকা ম্যাট ১২৪ জি ক্যামেরা ও ২৫টি ফিল্ম। ক্যামেরা হস্তান্তরের ছবিটি তুললেন লুৎফর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী ওয়াদুদ। দুই মাস পর বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা লুৎফর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডাকলেন। নতুন ১০ টাকার নোট দেখিয়ে বললেন, ‘আপনার তোলা ছবি দিয়ে টাকা ছাপানো হয়েছে।’ তিন হাজার টাকা হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আপনার জন্য শুভেচ্ছা উপহার। টাকাটা বড় কথা নয়, সবার হাতে আপনার তোলা ছবি থাকবে; এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে!’

কাগুজে নোটগুলোয় ব্যবহৃত বঙ্গবন্ধুর সেই ছবি তোলার গল্পটিও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ছবিটি ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর তোলা হয়েছিল। ওই দিন দুপুরে বেতারের এক কর্মচারী টেপ রেকর্ডার নিয়ে ডিআইটির টেলিভিশন ভবনে যাচ্ছিলেন। ওই কর্মচারীর কাছেই শুনলেন, বঙ্গবন্ধু টেলিভিশনে নির্বাচনী ভাষণ দেবেন। ক্যামেরা নিয়ে শাহবাগের বেতার অফিস থেকে রওনা হলেন লুৎফর রহমান। টেলিভিশনের স্টুডিওতে গিয়ে দেখেন আবদুল্লাহ আল মামুন আর আতিকুল হক চৌধুরী রেকর্ডিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এলেন। চেয়ারে বসে কাগজে চোখ বোলাতে লাগলেন। ফ্লাশ জ্বালিয়ে ছবি তুলতেই বঙ্গবন্ধু তার দিকে তাকালেন। সবাই বললেন, ‘আগে রেকর্ড হয়ে যাক, তারপর ছবি নিন।’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ওকে আগে ছবি তুলতে দাও, তা না হলে ও মাঝে মাঝে বিরক্ত করবে।’ এ সময় টেবিলে চা এসে গেল। চায়ে চুমুক দিতেই তিনি আরেকটা ছবি তুললেন। বঙ্গবন্ধু চশমা খুলে ও পরে তাকে বেশ কয়েকটি ছবি তোলার সুযোগ দিলেন। ছবি তোলা শেষে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই এখন যা, আমাকে ছবি দিস।’ দুই দিন পর ধানম-ির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে ছবি দিয়ে এসেছিলেন লুৎফর রহমান।

বাংলাদেশে প্রথম নিজস্ব কাগুজে নোট মুদ্রিত হয় স্বাধীনতার তিন মাসের মধ্যে। তখন জরুরি ভিত্তিতে ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে ১ ও ১০০ টাকা মূল্যমানের নোট ছাপিয়ে আনা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ অবমুক্ত হওয়া এসব নোটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত ছিল। ভারত থেকে ছাপানো নোটগুলোয় নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোট ছাপার প্রয়োজন হয়। সেই নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপার সিদ্ধান্ত হয়। বিশিষ্ট আলোকচিত্রীদের কাছে চাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেট। সেই সময় বেতারের আলোকচিত্রী লুৎফর রহমান তার তোলা একটি ছবি জমা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারির কাছে। আর সেই ছবি দিয়েই টাকা ছাপা হয়। ১৯৫৪ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নানা ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি তুলেছেন লুৎফর রহমান। তার তোলা অসংখ্য ছবি বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাসের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। ছবিগুলো তার একমাত্র ছেলে আলোকচিত্রী মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু সযতেœ সংরক্ষণ করছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD